গত কয়েকদিন থেকেই রোকেয়া বেগম এর মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ তার স্বামীর উপর। কারণ এবার নিয়ে তিন বার তিনি এলাকার উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। প্রতিবারই ইলেকশন এর চব্বিশ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত একশত ভাগ নিশ্চিত হয়েও ফলাফল শূন্য! তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে রোকেয়া বেগম কি প্রচারণাই না করেছিলেন! সাধারণ পুরুষ মানুষ ও হার মানবে তার প্রচেষ্টার কাছে। সব শ্রমই পণ্ড হলো এই গাঁধা ব্যাটার জন্য। সাধু হয়ে কি নির্বাচন করা যায়! গলায় মিথ্যের জোর থাকতে হয়। সেই সব স্মৃতি মনে হলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় রোকেয়া বেগমের। ইদানিং স্ত্রীর উচ্চ গলার আওয়াজ পেলেই কাবুল চেয়ারম্যান (এলাকার লোকজন ভালোবেসে কাবুল সাহেবকে চেয়ারম্যান ডাকে! তিনিও হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন) গৃহত্যাগ করেন। ভয়ে নাকি লজ্জায় তা ঠিক নিজেও জানেননা। যখন ফিরে আসেন তখন সাথে করে নিয়ে আসেন তার প্রিয় বন্ধুদের কাউকে। যাতে করে স্ত্রীর কাছে তাকে নির্বাচন বিষয়ক কিছু শুনতে না হয়। আজ এসেছে নিজাম খাঁ। তার একজন কাছের বন্ধু। নির্বাচনে মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্রতিবারই যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের একজন। এতোটা যদিও কাবুল মিয়া তার বন্ধুদের কাছ থেকে কখনই আশা করেননি। তাই একটা খটকা মনের মধ্যে গত তিন বছর বয়ে বেড়াচ্ছেন। যখনই মনে করেন তিনি তার বন্ধুদের এই সহযোগিতার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন তখনই নিজেকে নিজের কাছে খুব ছোট মনে হয়। তিনি বুঝতে পারেন স্ত্রীর সাথে বন্ধুদের কেমন যেন একটা সখ্য তৈরি হয়েছে! যা তার ভালো লাগেনা। ইদানিং খুব একা মনে হয়। মনে হয় যেন নিজের সংসারের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথায়ও! তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর ইলেকশনে যাবেননা। বাবার যা আছে তাই নিয়ে অন্তত সুখে থাকবেন। রোকেয়া বেগমের তিন সন্তানই গত কয়েকদিন থেকে খুব উৎফুল্ল মনে আছেন। কারণ তাদের প্রিয় নিজাম আংকেল তাদের ঢাকা থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ঢাকার স্কুল-কলেজে ভর্তি হলে ছেলে-মেয়ের কপাল খুলে যাবে এমনই বুঝিয়েছেন বন্ধু কাবুলকে। ওদের দেখাশুনারও সমস্যা হবেনা যেহেতু নিজাম খাঁর নিজেরই ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় আসতে হয়। তার নিজেরও একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করা আছে। এমন কথা শুনে রোকেয়া বেগম এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু স্ত্রীর কথায় একমত পোষণ না করায় রাতে শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। অবশেষে চেয়ারম্যানের গৃহত্যাগ। রোকেয়া বেগম সন্তানদের দেখাশুনার জন্য তিনিও ঢাকা থাকবেন বলে ঠিক করেছেন। কাবুল মিয়া গ্রাম থেকে টাকা পাঠাবেন তাদের জন্য। এমনটাই ফাইনাল বললেন স্বামীকে রোকেয়া বেগম। তার জন্য নিজের এবং সন্তানদের লাইফ নষ্ট হতে দেবেন না। গ্রামে কাবুল মিয়ার মা-বোন আছে। তারাই দেখাশুনা করবেন তার। স্ত্রীর মুখে এসব কথা শুনে কাবুল মিয়া বুঝে গেছেন তার আর এই সংসারে নিয়ন্ত্রণ নেই। স্ত্রী-সন্তান সবাই কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে গেছে। সবার মধ্যে কেমন একটা ভয়ংকর স্বাধীনতা চলে এসেছে! অবশ্য এই পরিস্থিতির সুত্রপাত যে নিজের অজান্তে তিনিই করেছেন গত কয়েক বছর ধরে তা এখন ভালই বুঝতে পারছেন কাবুল চেয়ারম্যান। দ্বিতীয়বার যখন সবাই ব্যস্ত নির্বাচনী প্রচারণায় তখন ঘটে গেলো পরিবারে একটি দুর্ঘটনা। ছোট মেয়ে তখন ক্লাস টেন এ পড়ে। আর ছোট ছেলে ক্লাস নাইন এ। বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাবা-মা’র সাথে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। রোকেয়া বেগম অনেকটা মুক্তমনা হওয়ায় বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের বন্ধু-বান্ধবিদের যাতায়াত ছিল প্রায়ই। একদিন সন্ধায় সবাই প্রচারনী শেষে এসে দেখেন কাবুল চেয়ারম্যান এর ভাই একটি ছেলেকে উঠোনে গাছের সাথে বেধে রেখেছেন। পরে কারণ জানা গেলো ছেলেটি কে পাওয়া গেছে চেয়ারম্যান এর ঘরে তার ছোট মেয়ের সাথে। ছেলেটির নাম রুবেল। প্রায়ই আসতো ঘরে তার ছোট ছেলের বন্ধু। নির্বাচন কে সামনে রেখে বাবা-মা কেউই ঘটনাটা ঘাঁটাঘাঁটি করলেন না। শুধু রাতে একবার কাবুল মিয়া তার স্ত্রীকে বলেছিলেন “তোমাকে বলেছিলাম ঘরে মেয়েকে একা রেখে যেওনা” তাতেই তার ওই রাতে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে। অবশ্য এটা নতুন নয় তিনি প্রায়ই রোকেয়া বেগম এর ভয়ে গৃহত্যাগ করেন। কেউ গৃহত্যাগ করেন সৃষ্টিকর্তার খোঁজে আত্মশুদ্ধির জন্য। কাবুল চেয়ারম্যান গৃহত্যাগ করেন স্ত্রীর ভয়ে। তবে এটাও একটা আত্মশুদ্ধির অঘোষিত নিয়ম। আজ পরিবারের সবাই চলে যাচ্ছে স্বপ্নের শহর ঢাকা। শুধু রয়ে যাচ্ছেন কাবুল মিয়া। তাই লঞ্চঘাটে যখন সবাইকে বিদায় জানাচ্ছেন তখন ভিতরটা কেমন হু হু করে উঠলো। তখন খুব জানতে ইচ্ছে করছিল তার মত ওদেরও কি বাবার জন্য খারাপ লাগছে কিনা! স্ত্রী-সন্তান কাবুল মিয়াকে বিদায় জানিয়ে কেবিনে ঢুকে গেলেন। মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেলো চেয়ারম্যানের চোখ। পাছে লোকে দেখে ফেলার ভয়ে দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু খুব বুঝতে পারছেন যে এই চেষ্টা তার গত তিন বারের নির্বাচনের মতই বৃথা হবে। চেয়ারম্যান কাঁদছে.........তার চারপাশ ভরে গেলো উৎসুক দৃষ্টিতে................................. প্রায় পনেরো দিন লাগলো নিজাম খাঁর নতুন বাসা ভাড়া করতে রোকেয়া বেগমদের জন্য। এতো দিন তারা খাঁ সাহেবের বাসাতেই ছিল। ছেলে-মেয়েরা মহা আনন্দে আছে। বিকেলে শপিং করতে যাচ্ছে মা-মেয়ে এবং আংকেল। নতুন বাসায় উঠেই রোকেয়া বেগম তার স্বামী কে ফোন দিলেন “এই শুনো কালকেই তুমি আমাদের জন্য টাকা পাঠাবে কারণ বাসা ভাড়া...ওদের ভর্তি... বাসার ফার্নিচার........................” তিন ছেলে-মেয়েকে আংকেল বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ভর্তি করে দিলেন। এখন সবাই ব্যস্ত যার যার স্কুল-কলেজ নিয়ে। নিজাম খাঁ এখন আসে সাধারণত ছেলে-মেয়েরা বাইরে থাকলে। অবশ্য এটা রোকেয়া বেগমই বলে দিয়েছেন। কারণ ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কেমন যেন লাগে! মন খুলে নিজেদের মত কথা বলা যায়না। নিজাম খাঁর এখন গ্রামের চেয়ে ঢাকাতেই থাকতে হয় বেশী সময়। কারণ তার ব্যবসা-বানিজ্য নাকি সব ঢাকাতেই হবে। গ্রামে কিচ্ছু হবেনা। সব চোর-বাটপার! দীর্ঘ তিন মাস পর কাবুল চেয়ারম্যান ঢাকা আসলেন তার পরিবারের সাথে দেখা করতে। স্ত্রী-সন্তানকে ঠিক যেন চিনতে পারছেন না। ছেলে দুটোকে কেমন যেন নেশাখোরের মত লাগছে। মেয়েটাকে মনে হচ্ছে অনাহারী। বাসায় আরও একটি ছেলেকে লক্ষ্য করলো কাবুল মিয়া। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করায় জানা গেলো তাদের গ্রামেরই ছেলে। ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে ঢাকায়। থাকার জায়গা নেই বলে বড় ছেলে বাসায় নিয়ে এসেছে। বিকেলে বাসায় জমে উঠলো (গ্রামে যাকে বলে জলসা) আড্ডা। নিজাম খাঁ চলে এসেছে। কারণ আজ তার সবচেয়ে প্রিয় (?) বন্ধু চলে এসেছে। তার জন্য বাসায় আজ উৎসব উৎসব ভাব। কাবুল চেয়ারম্যান এমন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেননা। তার কেবলই মনে হচ্ছে স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সাথে যতটুকু আন্তরিক হওয়ার কথা তিনি তা আর পারছেনা। বরং বন্ধু নিজাম খাঁ স্ত্রীর সাথে যথেষ্ট আন্তরিক। একদিনের বেশী ঢাকাতে থাকতে পারলেননা কাবুল মিয়া। গ্রামে জরুরী কাজের কথা বলে আবারও তাকে গৃহত্যাগ করতে হলো। এভাবে প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো.................. বড় ছেলে পরীক্ষায় ফেল করে লাইফ এ তেমন কোন পরিবর্তন হলোনা। ছোট ছেলে নাকি এখন প্রায়ই রোকেয়া বেগম এর সাথে খারাপ আচরণ করে। রোকেয়া বেগমের মনে হচ্ছে ছেলেটার কিছু একটা হয়েছে। রোজ রাত করে বাড়ি ফেরে। কারণ জানতে চাইলেই কেমন করে যেন তাকায়। কথা বললেই মুখ থেকে কেমন কটু গন্ধ বের হয়। রোকেয়া বেগম এর ভয় লাগে। দেশ থেকে হঠাৎ সবাই ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হলো। কারণ কাবুল চেয়ারম্যানের ছোট মেয়ের বিয়ে। খবরটা শুনে প্রথমে কাবুল মিয়া একটু অবাক হলেও তার কিছু যে করার নেই তা তিনি বুঝতে পারছেন। মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন রোকেয়া এবং নিজাম খাঁ। আজ কন্যার বিয়ে। কাবুল মিয়া তার মা, ভাইবোন সবাই ঢাকার বাসায় উপস্থিত। কিন্তু কেমন যেন লাগছে বাসার পরিবেশ। এমন অবস্থা তিনি যেচে কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছেন না। কারণ রোকেয়া কে তিনি খুজে পাচ্ছেন না। বাসায় কিছু অপরিচিত মানুষ। হঠাৎ বাসায় এলেন নিজাম খাঁ। তিনি যা বললেন তাতে কাবুল চেয়ারম্যান একটুও বিচলিত হলেন না। যেন জানতেন এমনই হবার কথা। তার ছোট মেয়ে কাল থেকে এখনও বাসায় ফেরেনি। অথচ আজ বিয়ে। রোকেয়া বেগম জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। স্বামীকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন.........“আমার মেয়েকে এনে দাও”। ইচ্ছে করছে কাবুল চেয়ারম্যানের ও কাঁদতে। কিন্তু তাকে কাঁদলে হবেনা তার এখন পরিবারের জন্য অনেক কাজ করতে হবে। কাবুল মিয়া ছুটলেন মেয়েকে খুজতে.........তার চোখ আবার ও ঝাপসা হয়ে আসছে......... তার পিছনে হেঁটে চলছেন নিজাম খাঁ.........................................................
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল
# খুবই সুন্দর গল্প । গল্পের সব ফ্রেবারই কমবেশী এতে রয়েছে । একটা বাড়ী বা পরিবারের মেইন উপাদান হলো---অন্দর ও বাহির । এই-- অন্দর ও বাহিরের বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে উৎখাত করে দিলে----, যাতড়পাতের আর কিছু বাকী থাকে না । অধোঃপকন নেমে আছে । ধন্যবাদ ।।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।